ভুল মানুষই করে। আবার সেই ভুলের মাশুলও দেয় মানুষ। তবে কথা থাকে। মানুষ ভুল করে ভুল শুধরানোর সুযোগ পেলে কেউ কেউ একই ভুল দ্বিতীয়বার আর করে না। সুযোগের অভাবেই হোক আর মন পরিবর্তনের কারণেই হোক, যারা অপরাধ করে, তাদের মধ্যে একসময় একটা পরিবর্তন কিন্তু আসে। আবার অনেকে মন পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগায় না। ইচ্ছা করেই যেন একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটায় বারংবার। বিশেষ করে যারা পেশাদারি তারা কখনো ভুল করে মন পরিবর্তনের কথা ভাবে না। অনেকে আবার স্বভাবগত কারণে বারংবার একই ভুল করে থাকে। এটা বয়সের ওপর যেমন নির্ভর করে, তেমনি পারিপার্শ্বিকতার ওপরেও নির্ভর করে। এই ভুল যত বড়ই হোক, বয়সের ওপর নির্ভর করে বিচার করার নিয়ম এক থাকলেও তাদের শাস্তি হয় ভিন্ন। তবে বয়সের ওপর নির্ভর করে অন্যায়কারীদের বিচার ভিন্নভাবে না করা হলেও তাদের ভুলের পরিমাপের ওপর এবং বয়সের ওপর নির্ভর করে শাস্তি দেওয়া দেওয়া ভিন্ন।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রাপ্ত বয়সের আগে কেউ কোনো ধরনের ভুল বা অপরাধ করলে তাদের মন পরিবর্তন করার সুযোগ দেওয়ার যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্করা যেমন বুঝেশুনে কোনো ভুল বা অপরাধ করে, অপ্রাপ্তবয়স্করা তেমনটা বুঝে বা জেনে করে না (কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে)। সুতরাং কেন তাদের ভুল বোঝার সুযোগ দেওয়া হবে না এবং একই ভুল দ্বিতীয়বার না করার ব্যবস্থা করে সঠিক পথে চলার সুযোগ থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে? একবার কোনো বড় ভুল বা অপরাধ করে যদি মন পরিবর্তন করে সে ভালো পথে যেতে পারে, তাহলে তাকে সেই সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে। নিয়ম তো মানুষই করে। মানুষই আবার সেই নিয়ম ভঙ্গ করে। এই নিয়মের ধারক-বাহক যে মানুষই।
সম্প্রতি দেশের অতি আলোচিত একটি ঘটনাকে নিয়েই মূলত আমার এই লেখা। ঐশী রহমান নামের একটি মেয়ে তার বাবা-মাকে নিজের হাতে খুন করেছে। সুতরাং আইনের দৃষ্টিতে সে খুনি। নিজেও স্বীকার করেছে সে তার বাবা-মায়ের খুনি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, খুনিকে ধরতে কিন্তু কারও কোনো প্রকার বেগ পেতে বা কারও কোনো সমস্যা হয়নি। ঘটনার দুই দিন পর নিজেই গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে ঘটনার কথা স্বীকার করেছে। আমার মনে হয়নি, পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে সে ভেবেছে, নিজে থেকে ধরা দিলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেবে। সুতরাং বুঝতে হবে সে কিছুটা হলেও ঘটনা ঘটানোর পরে বিবেকের দংশনে পড়ে। যে কারণে নিজে থেকে গিয়ে সে ধরা দেয়।
যেহেতু খুন করেছে সুতরাং বিচার তার হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আদালতে তাকে অন্য আর দশজন আসামির মতোন হাজির করা দরকার। তাই করা হয়েছে। বিচারে সে দোষী সাব্যস্ত হওয়াতে তার শাস্তি হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। এই রায় শোনার পর অনেকেই ঐশীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার পক্ষে কথা বলেছেন বা লেখালেখি করেছেন। আমি নিজেও তাই করেছি। এর কারণ ছিল, ঐশী যখন তার বাবা-মাকে খুন করে, তখন তার বয়স ছিল উনিশ। অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়সে সে খুন করেছে তার বাবা-মাকে। তা ছাড়া, খুনের কারণ জানা দরকার আগে। এমন কোনো কারণ থাকতে পারে, যে কারণে ঐশী তার বাবা-মাকে খুন করে। অন্য কোনো পথ হয়তো ছিল না। সেই কারণ জানা থাকলে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যেত। তাই সবকিছু ভেবে, এই রায় পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করার দাবি তোলা হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি আমলে নিয়ে, তা পুনর্বিবেচনা করা হয়। পুনর্বিবেচনায় ঐশীর শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে এনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়েছে।
আমি মনে করি, কর্তৃপক্ষ যদি সারা জীবন কারাবাসের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত থাকে তাহলে শাস্তি লাঘব করেও কোনো লাভ হয়নি। কারণ নিজ ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে যে শাস্তি সে নিজে থেকে পেয়েছে, তার ওপর আর কোনো শাস্তি হতে পারে না। আমার দৃষ্টিতে কোনো অপরাধী বা আসামিকে তার অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তা কার্যকর করাই কোনো শাস্তি নয়। মেরে ফেলা মানে মেরে ফেলাই। সে কখনো বুঝতে পারে না যে তার অপকর্মের ফলে তাকে কি শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া তার অনুশোচনার কোনো পথ খোলা থাকে না। যাতে করে সে কখনো ভালো হতে পারে। সুতরাং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া এবং তা কার্যকর করা হচ্ছে খুনের বদলে খুন। শাস্তি হতে হবে এমন, যা পেয়ে বা জেনে এবং যা ভোগ করে অপরাধী বুঝতে পারে তার অপকর্ম বা অপরাধের জন্য এই শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। সেই শাস্তি ভোগ করার পাশাপাশি যেকোনো অপরাধী ভালো হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমরা প্রতিটি অপরাধীর ক্ষেত্রেই সেটা কামনা করি। যা ঐশী রহমানের ক্ষেত্রে হয়েছে। আমরা যারা ঐশীর বেলাতে এমনটা চেয়েছিলাম তারা মনে হয় সকলেই খুশি। এমনটা শুধু ঐশীর ক্ষেত্রেই নয়, সবার ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া উচিত মনে করি। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো মানুষই জন্মগতভাবে অপরাধী হয়ে জন্মায় না।
লেখক
ঐশীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে এনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করার ফলে যা হবে, তা হচ্ছে এখন কারাগারে সে শুধু হয়তো শুয়ে-বসে থাকবে। হয়তো কিছু কঠিন কাজও করতে হতে পারে তাকে। তবে শুয়ে-বসে থাকলে শুধু মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া তার আর কিছুই হবে না। এর চেয়ে তার মৃত্যুদণ্ডই আরও ভালো ছিল। যেহেতু তার শাস্তি কমিয়ে এনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সুতরাং ঐশীকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিয়ে অবজারভেশনে রাখা দরকার। হতেও পারে সে নিজে থেকে সেই সুযোগে অনেক ভালো হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে নিজের জন্য, সমাজের জন্য তথা জাতির জন্য অনেক ভালো কিছু করতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানি।
অনেক দিন আগে ঐশী রহমানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ শোনার পর আমি আমার ফেসবুকে আইডিতে স্ট্যাটাস দিয়ে ঐশীকে বাঁচিয়ে রেখে মন পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে লিখেছিলাম। তখন বেশ কিছু ছেলে মেয়ে আমাকে সমর্থন দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছিল—আপনি ঐশীর পক্ষে লেখাতে আপনার প্রতি আমাদের অনেকটা শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। আমি ওদের শ্রদ্ধা ধরে রেখে অন্যদের প্রতিও তাদের অনেকের শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠুক সেই প্রত্যাশা করব। যারা ভুল করে অপরাধ করে তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
তবে সবচেয়ে বড় বিষয় ঐশীরা কেন অপরাধ করে, কেন তারা অপরাধ করতে বাধ্য হচ্ছে এর মূল কারণ উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। সেই মূল কারণকে চিহ্নিত করে সমাধানও করতে হবে। তা করতে না পারলে আমাদের এক ঐশীকে জেলে রেখে কোনো লাভ হবে না। হাজারটাও ঐশীর জন্ম নিবে এই সমাজে। আমাদের কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টি দিতে হবে ভিন্ন জায়গায়। আশা করি এখন থেকে তাই করা হবে। তা না হলে আমাদের তরুণ সমাজ তরুণ অবস্থাতেই শেষ হয়ে যাবে।
*লেখক জাপানের টোকিওপ্রবাসী।
Source; Prothom Alo
0 comments:
Post a Comment