এক ফালি চাঁদে কী থাকে? আলোও তো সেভাবে ছড়ায় না। কিন্তু সন্ধ্যার আকাশে একপলক তার দেখা মিলতেই কোটি প্রাণে অন্যরকম এক স্পন্দন ছুঁয়ে যায়। রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আকাশে সেই চাঁদ উঠে। পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ। সোমবার উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
আকাশে চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় পটকার শব্দ শোনা গেছে। রাতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় সেই শব্দ শোনা গেছে। জনস্রোতের রাজধানী তার চিরপরিচিত চেহারাটি হারিয়েছে বটে। অনেকেই এ শহর ছেড়ে চলে গেছে। তাতে উৎসবের আমেজ নষ্ট হয়নি এতটুকুও। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাউন্ড সিস্টেমে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে উচ্ছ্বাস, কিছুটা বেপরোয়া বাইকে উচ্ছ্বসিত তরুণদের হর্ষধ্বনি, বিপণি বিতানে শেষ মুহূর্তের ভিড়, সদরঘাট বা টার্মিনালে মানুষের ছোটাছুটি, আর মনোহরা দোকানগুলিতে সওদাপাতির জন্য ক্রেতার জট—এ সবই উৎসবের জানান দিচ্ছে।
রাজধানীর রাস্তায় নেমে শাহবাগের ফুলের দোকানে চাঁদরাত ঘিরে উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে প্রথম। এক দোকানি সারোয়ার বললেন, ‘সারা দিনে বেচছি চার শ টাকা। এহন ভাই সন্ধ্যার পর বেচাবিক্রি শুরু করছি ভালোভাবে।’ কয়েক দোকানি জানান, প্রতি চাঁদরাতেই তাদের বেচাবিক্রি ভালো হয়। মানুষ মূলত ঘর সাজানোর জন্যই ফুল কেনে। একটি বেসরকারি কোম্পানির চাকুরে নিলুফার আহমেদ বললেন, ‘ফুল ঘরে থাকলে কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব থাকে। তার জন্যই ফুল কেনা।’
শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পেরিয়ে ফুলবাড়িয়ায় গিয়ে কানে তালা লাগার জোগাড়। মেয়র হানিফ উড়াল সড়কের পাশজুড়ে সেক্রেটারিয়েট রোডে ছোটখাটো দোকান। সেসবে লেনদেন বন্ধ। এসব দোকানে বড় বড় সাউন্ড বক্স বাজিয়ে উচ্চ স্বরে গান বাজছে। পোলট্রির যন্ত্রাংশ তৈরির এমন একটি দোকানের মালিক নীরব আহমেদের কথা, ‘চাঁদ দ্যাখার পর থাইক্যাই বাজনা শুরু হইছে। চলব সারা রাত।’
এসব আনন্দের মাঝে চলছে শেষ সময়ের কেনাকাটা। বঙ্গবাজারে মার্কেটের সরু গলিগুলো ঠেলে যেতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি চলছে রাত প্রায় নয়টার দিকেও। একমাত্র সন্তানের জন্য এখানে একটি প্যান্ট পছন্দ করছিলেন সাহানা খাতুন। ঘরে সেলাইয়ের কাজ করে চলে তাঁর সংসার। বললেন, ‘ছেলের একটা প্যান্ট আগে কিনছিলাম। আরাকটা দিতে চাইছিলাম, সেই জন্যই আসলাম।’
রাজধানীর ফাঁকা ফাঁকা বড় সড়কগুলো এ শহর ছেড়ে ছেড়ে মানুষের গ্রামে চলে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেও পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডে গিয়ে কিন্তু ভিন্ন চিত্র। ছোট এই সড়কে অজস্র মানুষের ভিড়। রিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার এমনকি পিকআপ। সবকিছু শ্লথ করে দিয়েছে রাস্তাটিকে। রাস্তায় থাকা ব্যস্ত পথিক গন্তব্যে পৌঁছাতে হাঁকডাক করছেন বিস্তর। রাস্তার দুপাশের মাংস, মনোহরা, ফলের দোকানে চলছে বিকিকিনি। ভিড় ঠেলে বাহাদুর শাহ পার্কের দিকে এগোতে থাকলে নতুন এক জনস্রোত চোখে পড়ল। এর গন্তব্য সদর ঘাটের নৌযানগুলো। কেউ একা, কেউ পরিবার সমেত ব্যাগ নিয়ে ঘাটমুখী। বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার পাশে গড়ে ওটা দোকানে এসব যাত্রীদের কেউ কেউ লেগে গেছেন কেনাকাটায়। এঁদের একজন শরীয়তপুরের সদরের বাসিন্দা আশরাফ। সাভারে একটি ছোট ব্যবসায় করেন। ঘাটে আসার পথে মা তাঁকে একটি পাঞ্জাবি কিনতে বলেছেন কোনো এক আত্মীয়ের জন্য। সে জন্যই লঞ্চের ওঠার আগ মুহূর্তের এই কেনাকাটা।
সদরঘাটে এভাবেই সারা রাত চলবে বেচাকেনা। ছবি: আবদুস সালাম
চাঁদরাতে কেনাকাটার মাঝে এক ভিন্ন ধরনের আনন্দ অনুভব করেন অনেকে। তাই ইচ্ছে করেই তারা এ রাতের জন্য কিছু কেনাকাটা বাকি রাখেন। এমন একজনের সন্ধান মিলল সদর ঘাটের শরীফ মার্কেটে। এখানে দেখা কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনটি পাঞ্জাবি কিনলেন দুই হাজার টাকা দিয়ে। বললেন, ‘চাঁদরাতে না কিনলে উৎসবের ভাবই আসে না। ইচ্ছা করেই বাদ রেখে দিছিলাম কেনা।’
এ মার্কেটে খ্যাত পাঞ্জাবির জন্য। সাত তলা মার্কেটটির নিচতলা বাদ দিয়ে পুরোটাই পাইকারি মার্কেট। নিচতলায় চলছে ধুন্ধুমার বিকিকিনি। তালুকদার গার্মেন্টস নামের এক দোকানের স্বত্বাধিকারী মো. রেজা বললেন, ‘ফজরের আজান পর্যন্ত কেনাকাটা চলব।’
সদরঘাটের এ মার্কেট থেকে সোজা বিলাসবহুল বিপণি কেন্দ্র কারওয়ান বাজার সংলগ্ন বসুন্ধরা সিটি। গত প্রায় এক মাস ধরে হোটেল সোনারগাঁর সামনের চার রাস্তার মোড়ের যানজট রাত সাড়ে ১০ টাতেও অটুট। মার্কেট থেকে যারা বেরুচ্ছে তাদের হাতে হাতে ব্যাগ। আর ঢুকছে অসংখ্য মানুষ। এখানে আড়ং এর বিক্রয় কর্মী রফিকুল বললেন, ‘এখন ডিসপ্লেতে যা দেখছেন এটুকুই আছে। কোনো ভিন্ন সাইজ দিতে পারব না। বারোটা পর্যন্ত চলবে কেনাকাটা।’
কেনাকাটার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। সাদেকুল ইসলাম স্ত্রী, দুই সন্তানকে নিয়ে রাতের ভোজন এবং দীর্ঘ রাত ধরে কেনাকাটার পরিকল্পনা নিয়েই বেরিয়েছেন। জানালেন, কেনাকাটা আগেই শেষ হয়েছে। তবে এ রাতের জন্য তুলে রাখা হয়েছিল অবশিষ্টটুকু, ইচ্ছে করেই। এ রাতের আনন্দকে আরও জাঁকালো করতে।
Source: Prothom Alo
0 comments:
Post a Comment