২০১২ সালের জুন মাসে রাখাইনে বৌদ্ধ এবং মুসলমানদের মধ্যকার দাঙ্গা ও সন্ত্রাস বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়। বহু মানুষ নিহত এবং প্রায় দেড় লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটে। রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সেই বিপর্যয়কর ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে এই মাসে। এ উপলক্ষে আন্তর্জাতিক দুর্গত সহায়তা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির সদ্যপ্রকাশিত প্রতিবেদনের ভাষান্তর এখানে তুলে দেওয়া হলো।
রাখাইন মিয়ানমারের দরিদ্রতম প্রদেশগুলোর অন্যতম। আমরা যখন ওই ঘটনার পঞ্চম বার্ষিকীতে রয়েছি, তখনো রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তইয়ের অদূরে প্রায় এক লাখ মানুষ আইডিপি (আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু ব্যক্তিদের আশ্রয়স্থল) ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এদের প্রায় সবাই রাষ্ট্রবিহীন, বাস্তুচ্যুত হওয়া আত্মস্বীকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা দেশটির এমনই একটি জনগোষ্ঠী, আশির দশকের গোড়া থেকে যাদের অধিকার ও স্বাধীনতা ধারাবাহিকভাবে খর্ব হয়ে চলেছে। জাতিগত সম্প্রদায় হিসেবে তাদের অস্তিত্ব মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে চলেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা প্রতিনিয়ত বলে চলেছেন, ওরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। এ পর্যন্ত এই হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষের সম্মানজনক পুনর্বাসন দূরবর্তী সম্ভাবনা হিসেবেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে অনুন্নয়নের করালগ্রাস। অব্যাহত মানবিক চ্যালেঞ্জ মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রায়ণের উত্তরণের ধারাকে ব্যাহত করছে। বিশ্বের দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধের অবসানকেও তা করে তুলেছে অনিশ্চিত।
পাঁচ বছর আগে যে সহিংসতা রাখাইনজুড়ে সংঘটিত হয়েছিল, তারপর অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়েছিল সিত্তইয়ের অস্থায়ী শরণার্থীশিবিরে। আর সেখানে একই ছাদের নিচে দশটি পরিবারকে মাথা গুঁজতে হয়েছে। এটা বিস্ময়কর নয় যে এসব পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য একই দুর্দশায় দিনাতিপাত করছে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের তরফে তাদের স্বাধীনভাবে চলাচলের ওপর রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি এবং কঠোর কড়াকড়ি। সবচেয়ে যা উদ্বেগজনক তা হলো, সাম্প্রতিক আইআরসি বিশ্লেষণে উদ্ঘাটিত হয়েছে যে শরণার্থীশিবিরের যা দৈন্যদশা, তা আন্তর্জাতিক মানবিক মানের নিচে রয়েছে। সেখানে পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের ঝুঁকি, বাল্যবিবাহ এবং ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে অনটনের মধ্যে জীবনযাপনেরÿকারণে নিরাময়যোগ্য রোগে মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। আইআরসির ওই বিশ্লেষণে নির্দিষ্টভাবে দেখা গেছে, যক্ষ্মার মতো রোগের বিস্তারের হার রাখাইনের অবশিষ্ট অংশের চেয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে দশ গুণেরও বেশি। রাখাইনের এই অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষগুলোর মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মনোভাবের ঘাটতি প্রবল। এসবের কারণে সরকার এবং এই মানুষগুলোর মধ্যে কোনো শান্তি স্থাপনের সম্ভাবনা অতীব দুর্বল।
রাখাইনের এ চলমান সংকটের মোকাবিলায় কফি আনানের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা কমিশন মিয়ানমারের সরকারের কাছে শরণার্থীশিবির বন্ধসংক্রান্ত একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রাখাইনের বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর পুনঃ একত্রীকরণে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও আছে। যদিও আইআরসি আনান কমিশনের ওই সুপারিশের সঙ্গে একমত। তদুপরি এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে সে ধরনের কোনো কৌশল গ্রহণের প্রক্রিয়া যেন সেখানকার বিদ্যমান শোচনীয় ও মানবেতর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর আশু উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে কোনোভাবে পিছিয়ে না দেয়। ভবিষ্যতের কিংবা চলমান কোনো উন্নয়ন উদ্যোগের ভিত্তি হতে হবে শরণার্থীদের চাহিদা পূরণের দিকে যত্নবান হওয়া এবং একই সঙ্গে তা হতে হবে বৈষম্যবিরোধী। অবশ্য খাদ্যনিরাপত্তা, দুর্যোগ-ঝুঁকি হ্রাস এবং গণসেবাসমূহের প্রতি জরুরি সমর্থনদানের মতো বিষয় আশু দৃষ্টিপাতের দাবি রাখে। এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরি ভিত্তিতে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এসবের প্রতি নজর দেওয়ার বিষয়টি বর্তমানে এতটাই জরুরি ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যার প্রয়োজনীয়তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র। এসব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হলে তা মিয়ানমারের অস্থির রাজ্যগুলোর ক্রমবর্ধমান ও দীর্ঘমেয়াদি মানবিক চাহিদা মেটানোয় সহায়তা দেবে।
উন্নয়ন সাহায্য এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু যা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য তা হলো, এসব উদ্যোগ হতে হবে সংঘাত-সংবেদনশীল, যাতে বিদ্যমান উত্তেজনার প্রশমন ঘটে। মিয়ানমারের বহুমুখী ও দশকদীর্ঘ জাতিগত সংঘাতের মধ্যে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চলের শান এবং কাচিন রাজ্যগুলোতে বিরোধ চলমান রয়েছে। সারা দেশে তাদের পাঁচ লাখের বেশি মানুষ চরম মানবিক সমস্যায় এবং প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে। রাখাইন এবং অন্য রাজ্যগুলোসহ আইআরসি মিয়ানমারের সবচেয়ে দুস্থ মানুষগুলোর জীবনের নিরাপত্তা এবং তাদের ভবিষ্যতের আস্থা পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় সহায়তা দিয়ে চলেছে। শুধু ২০১৬ সালে সংস্থাটি এ ধরনের ১ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। আইআরসির মতো এনজিওগুলোর সামর্থ্য অব্যাহত রাখতে উন্নয়ন-সুবিধা দিতে বাধাগ্রস্থ হওয়া এবং সম্পদ সরবরাহের ঘাটতির কারণে জরুরি ত্রাণকাজ বাধাগ্রস্ত হয়ে চলছে। জাতিসংঘের আবেদন সত্ত্বেও সাহায্যের পরিমাণ যথেষ্ট অপ্রতুল রয়ে গেছে। প্রত্যাশার চেয়ে সাহায্যের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। এর মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সাহায্যদাতা এবং মিয়ানমারে গণতন্ত্র আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই সবচেয়ে উদ্বেগজনক। কারণ, তারা বৈদেশিক সহায়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস করার প্রস্তাব করেছে।
পাঁচ বছর পরেও মিয়ানমারের জন্য রাখাইন সমস্যা প্রমাণের বিষয় হিসেবে থেকে গেছে। রোহিঙ্গাদের জরুরি মানবিক চাহিদা পূরণ করা দরকার। দীর্ঘকালীন উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে নির্দিষ্ট এবং মর্যাদাকর পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরি। জাতিগত, ধর্মীয় বা লিঙ্গ পরিচয়-নির্বিশেষে উন্নয়ন-প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এশিয়ার অন্যতম নবীন গণতন্ত্রের স্থিতি ও সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা এ অঞ্চলের জন্য একটি আশার প্রদীপ।
আইতর সানচেজ লাকোম্বা মিয়ানমারের ইন্টারন্যাশনাল রেসিকউ কমিটির কান্ট্রি ডিরেক্টর। রয়টার্স থমসন ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে। অনুবাদ: মিজানুর রহমান খান
Source:Prothom Alo
0 comments:
Post a Comment