গণপরিহনে নৈরাজ্য নতুন কিছু নয়। বলা যায় যে, কোনো কালেই এ পরিবহনে শৃঙ্খলা ছিল না। এ সেক্টর একটি উচ্ছৃঙ্খল ও অনিয়ন্ত্রিত সংস্থা। কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ প্রতিদিন এ সেক্টরের মুখাপেক্ষী। নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষের পরিবহনের মাধ্যম গণপরিবহন।
নানা নামে সারা দেশে এ পরিবহন রাস্তায় চলাচল করে থাকে। সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস, বিরতিহীন সার্ভিস, স্পেশাল সার্ভিস, দূরপাল্লার সার্ভিস, নানা ধরনের মন ভোলানো নামে পরিচালিত এসব গণসার্ভিসের কোনো মান নেই। তালিজোড়া ও রঙমালিশ করে মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়িই রুট আর নম্বর পাল্টিয়ে রাস্তায় চলে। গাড়ির মান নেই, ইঞ্জিন পুরনো, ভাঙা সিট, দরজা জানালা সব লক্কড়-ঝক্কড়। প্রায় ড্রাইভার হেলপারের নেই কোনো বৈধ লাইসেন্স। অদক্ষ ড্রাইভার হেলপারের গাড়ি চালানো, ট্রাফিক পুলিশের টোকেনে চলে প্রায় সব সিটি সার্ভিস ও সিটিং সার্ভিস।
বাংলাদেশের শহরের গণপরিবহনের এ চিত্র প্রায় এই ধরনের। আইন আছে, ট্রাফিক বিভাগ আছে, পরিবহন মালিক সমিতি আছে, অনেকগুলো শ্রমিক সংগঠনের তৎপরতাও দেখা যায়। যাত্রীদের দাবি আদায়ে যাত্রী কল্যাণ ফাউন্ডেশনসহ অনেকগুলো সংগঠনের তৎপরতা আছে। গণপরিবহনের শৃঙ্খলা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। সাধারণ যাত্রীরা সর্বদা হয়রানি আর ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে। সকাল-বিকেল অফিস টাইমে গণপরিবহনের যন্ত্রণায় কাহিল শ্রমজীবী মানুষ। বাসা ঘরমুখী জনগণ কি যে ভোগান্তির স্বীকার তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখার পরও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে।
অসহায় যাত্রী সাধারণ রাস্তায় এক শ্রেণীর সন্ত্রাসী পরিবহন শ্রমিকদের হাতে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রশাসনের সাথে পরিবহন মালিক শ্রমিকের সখ্য এ জন্য দায়ী বলে মনে করে অনেকে। মাঝে মধ্যে জনগণকে শান্ত রাখতে দু-একটি বক্তব্য ছাড়া প্রশাসন থেকে আর কিছু দেখা যায় না। এভাবে এ খাতকে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ক্রমান্নয়ে তা আরো জটিল হচ্ছে। দেশের কোনো শহরে শৃঙ্খলার মধ্যে গণপরিবহন চলে না। ভাড়ায় নৈরাজ্য ও ব্যবহারে মারমুখী পরিবহন শ্রমিকদের আচরণের বৈশিষ্ট্য। যা দেশে শহরগুলোর নিত্যদিনের সংস্কৃতি।
এর জন্য কারা দায়ী সেটা পরিবহন শ্রমিক, মালিক ও প্রশাসন অবগত আছে।
তাদের বিরুদ্ধে আইনের কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। আইনকে পরিবহন শ্রমিক বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতির উত্তরণে কিছু পরামর্শ দিতে চাই।
ক. গণপরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত ড্রাইভার হেলপাদের গাড়ি চালানোর আগে বয়স ১৮ পূর্ণ হতে হবে।
খ. তাদের জন্য গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণের সাথে যাত্রীদের সাথে ব্যবহার, পরিবহন সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
গ. দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি একজন ড্রাইভার হেলপার কখনো যেন গাড়িতে কর্মরত না থাকে ।
ঘ. পরিচয়পত্র বা লাইসেন্স ছাড়া কোনো ড্রাইভার হেলপারকে গাড়ি চালাতে না দেয়া।
ঙ. মাদক ও নেশা খোর পরিবহন শ্রমিকদের গাড়িতে চাকরি না দেয়া।
চ. নির্দিষ্ট স্টপিজ ছাড়া অন্য কোথাও গাড়ি না থামানোর ব্যবস্থা করা।
ছ. গণপরিবহনে ভাড়ার তালিকা ব্যবহার করা।
জ. ট্রাফিক সিগন্যাল, আইন অমান্যকারী গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
ঝ. দুর্ঘটনায় নিহত, আহতদের ক্ষতি পূরণে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার জন্য সরকার ও মালিক পক্ষের জরুরি তহবিলের ব্যবস্থা রাখা।
ঞ. গণপরিবহনে নারী আসন সংরক্ষণ করা।
ট. সকাল বিকেল অফিস টাইমে শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক চাপ থাকে। এ সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিবহনের ব্যবস্থা রাখা। ঠ. নির্দিষ্টভাবে সুনির্দিষ্ট রুটের জন্য বরাদ্দ গাড়ি রিজার্ভের নামে ভাড়া যাওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেকার পড়ে থাকা গাড়ি রিজার্ভের ভাড়ায় যেতে পারে।
মূলত গণপরিবহনের শৃঙ্খলা আনতে হলে অবশ্যই শ্রমিক মালিক প্রশাসন, যাত্রী কল্যাণ নেতরা সবার মধ্যেই গণপরিবহনের শৃঙ্খলাপূর্ণ সমন্বয় থাকতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করে নিয়মিতভাবে মনিটরিং করে জনভোগান্তি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। বিআরটিএর অনিয়ম ও বাণিজ্য বন্ধ করে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলার জন্য এ রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। যে ধরনের সুফল এ সংস্থা থেকে পাওয়ার কথা ছিল পরিবহন খাত ও যাত্রী কিন্তু কেউ তা পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটি-এ গণপরিবহন সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সুফল আসতে পারে। গণপরিবহনের এ খাতকে সেবামূলক খাতে পরিণত করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। সারা দেশের পরিবহননৈরাজ্য প্রতিরোধে প্রশাসনিক কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে জনগণ।
Source: Daily Nayadiganta
0 comments:
Post a Comment